অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের আবেদন

জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের জন্য আবেদন নিয়ে চিন্তিত? কারণটা সামান্য, কিন্তু ভোগান্তি বিশাল জন্ম নিবন্ধনে ভুল! নিজের নামে বানান ভুল, বাবা-মায়ের নামের অংশে অমিল, কিংবা জন্ম তারিখটাই গিয়েছে উল্টে। আমাদের অনেকেরই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। স্কুল, কলেজ, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র (NID), এমনকি বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সবখানেই এই এক টুকরো কাগজের বিশাল ভূমিকা।

কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ব্যাপারটা যতটা জটিল মনে হয়, আসলে ততটা নয়। সঠিক তথ্য আর একটু ধৈর্য থাকলেই আপনি খুব সহজে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। চলুন, আজ এই পুরো প্রক্রিয়াটা একদম সহজ ভাষায় জেনে নেওয়া যাক।

কী কী ভুল সংশোধন করা সম্ভব?

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, আপনি বেশ কিছু তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সবচেয়ে সাধারণ ভুলগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • নিজের নাম: বাংলা বা ইংরেজি বানানে ভুল।
  • বাবা-মায়ের নাম: বাংলা বা ইংরেজি বানানে অমিল।
  • জন্ম তারিখ: তবে এটি সংশোধন করা কিছুটা জটিল এবং এর জন্য শক্ত প্রমাণপত্রের প্রয়োজন হয়।
  • ঠিকানা: স্থায়ী বা বর্তমান ঠিকানায় ভুল।
  • লিঙ্গ বা জাতীয়তা: এ ধরনের তথ্যে ভুল থাকলেও তা পরিবর্তনযোগ্য।

অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের আবেদন

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এখন জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত সব আবেদন অনলাইনেই করতে হয়। এতে একদিকে যেমন সময় বাঁচে, তেমনই দালাল বা তৃতীয় পক্ষের ভোগান্তি থেকেও মুক্তি মেলে। চলুন, পুরো প্রক্রিয়াটি দেখে নেওয়া যাক।

ধাপ ১: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিন

আবেদন শুরু করার আগে কিছু ডকুমেন্ট স্ক্যান করে বা ছবি তুলে প্রস্তুত রাখতে হবে। কোন ভুলের জন্য কোন কাগজ লাগবে, তা আগে থেকে জেনে নেওয়া জরুরি।[3]

  • নাম বা বাবা-মায়ের নাম সংশোধনের জন্য:
    • আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ (SSC/HSC বা সমমান)।
    • আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)।
    • বাবা-মায়ের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র।
    • পাসপোর্ট বা কাবিননামার কপি (যদি থাকে)।
  • জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য:
    • শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ (SSC/HSC)।
    • জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)।
    • হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে দেওয়া জন্ম সনদ/টিকা কার্ড।
    • ডাক্তারের প্রত্যয়নপত্র।
  • ঠিকানা সংশোধনের জন্য:
    • জমির দলিলের কপি বা বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের রসিদ।
    • বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিলের কপি।
    • স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র।

গুরুত্বপূর্ণ নোট: বাবা-মায়ের নামে ভুল থাকলে, প্রথমে তাদের জন্ম নিবন্ধন সংশোধন করে নিতে হতে পারে। যদি তাদের জন্ম নিবন্ধন না থাকে বা তারা মৃত হন, সেক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আলাদা হতে পারে, যা আবেদন করার সময় পোর্টালে উল্লেখ করা থাকে।

ধাপ ২: সরকারি ওয়েবসাইটে প্রবেশ ও আবেদন শুরু

কাগজপত্র প্রস্তুত? এবার আসল কাজ শুরু করা যাক।

  1. প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন (BDRIS) ওয়েবসাইটের সংশোধন লিংকে প্রবেশ করুন: https://bdris.gov.bd/br/correction
  2. আপনার ১৭ ডিজিটের জন্ম নিবন্ধন নম্বর এবং জন্ম তারিখ দিয়ে “অনুসন্ধান” বাটনে ক্লিক করুন।
  3. আপনার তথ্য সঠিক হলে সেটি নির্বাচন করে “কনফার্ম” করুন।
  4. এরপর আপনার নিবন্ধনের কার্যালয় (ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন) নির্বাচন করুন।

ধাপ ৩: তথ্য পূরণ ও ডকুমেন্ট আপলোড

এই ধাপে আপনাকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।

  • “বিষয়” অংশ থেকে আপনি কী সংশোধন করতে চান (যেমন: নাম, পিতার নাম, জন্ম তারিখ) তা নির্বাচন করুন।
  • “সংশোধিত তথ্য” কলামে সঠিক তথ্যটি নির্ভুলভাবে টাইপ করুন।
  • “সংশোধনের কারণ” অংশে ড্রপডাউন মেন্যু থেকে “ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে” বা প্রযোজ্য কারণ নির্বাচন করুন।
  • এরপর আপনার প্রস্তুত রাখা প্রমাণপত্রের স্ক্যান কপি বা ছবি আপলোড করুন। ফাইল সাইজ নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে হবে।
  • সবশেষে আবেদনকারী ব্যক্তির তথ্য (যদি নিজের জন্য হয় “নিজ”, অন্য কারো হলে তার তথ্য) দিয়ে সাবমিট করুন।

ধাপ ৪: আবেদন ফি পরিশোধ

আবেদন সাবমিট করার পর আপনাকে একটি অ্যাপ্লিকেশন আইডি দেওয়া হবে। এই আইডি দিয়ে আপনাকে সরকারি ফি পরিশোধ করতে হবে। সাধারণত, মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে এই ফি জমা দেওয়া যায়।

ধাপ ৫: আবেদনপত্র জমা ও ফলোআপ

অনলাইনে আবেদন এবং ফি পরিশোধের পর আপনার কাজ প্রায় শেষ, তবে পুরোপুরি নয়।

  1. সাবমিট করা আবেদনপত্রের একটি প্রিন্ট কপি নিন।
  2. এর সাথে আপলোড করা সকল প্রমাণপত্রের ফটোকপি সংযুক্ত করুন।
  3. আপনার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে আবেদনপত্রটি জমা দিন।

এরপর কর্তৃপক্ষ আপনার আবেদন যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেবে। আপনি আপনার অ্যাপ্লিকেশন আইডি ব্যবহার করে অনলাইনে আবেদনের বর্তমান অবস্থা যাচাই করতে পারবেন।

আরও দেখুন: জন্ম নিবন্ধন অনলাইন আবেদন ২০২৫

জন্ম নিবন্ধন সংশোধন ফি: কত টাকা খরচ হবে?

খরচের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই চিন্তায় থাকেন। তবে সরকারি ফি খুবই সামান্য।

সংশোধনের ধরণসরকারি ফি (বাংলাদেশ)
তথ্য সংশোধন (নাম, ঠিকানা ইত্যাদি)৫০ টাকা
জন্ম তারিখ সংশোধন১০০ টাকা
সনদের বাংলা ও ইংরেজি কপি সংগ্রহ৫০ টাকা

দ্রষ্টব্য: এটি সরকারি ফি। স্থানীয় পর্যায়ে কম্পিউটার কম্পোজ বা অন্যান্য আনুষঙ্গিক কিছু খরচ হতে পারে।

সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQs)

প্রশ্ন: জন্ম নিবন্ধন সংশোধন হতে কত দিন সময় লাগে?
উত্তর: সাধারণত আবেদন জমা দেওয়ার পর ১৫ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। তবে এটি অফিসের কাজের চাপের ওপর নির্ভর করে কমবেশি হতে পারে।

প্রশ্ন: আমি কতবার আমার জন্ম নিবন্ধন সংশোধন করতে পারব?
উত্তর: সর্বশেষ নিয়ম অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি একাধিকবার তথ্য সংশোধনের আবেদন করতে পারেন, তবে প্রতিটি আবেদনের জন্য যৌক্তিক কারণ ও প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়।

প্রশ্ন: আমার জন্ম নিবন্ধনটি হাতে লেখা, আমি কি অনলাইনে আবেদন করতে পারব?
উত্তর: না, প্রথমে আপনাকে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে হাতে লেখা নিবন্ধনটি অনলাইন বা ডিজিটাল করে নিতে হবে। এরপর আপনি ১৭ ডিজিটের একটি নম্বর পাবেন, যা দিয়ে সংশোধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

প্রশ্ন: বাবা-মা মৃত হলে তাদের নাম কীভাবে সংশোধন করব?
উত্তর: যদি আপনার জন্ম তারিখ ০১/০১/২০০১ এর পরে হয় এবং বাবা-মা উভয়েই মৃত হন, তবে তাদের মৃত্যু সনদ দাখিল করে নাম সংশোধনের আবেদন করা যাবে।

শেষ কথা

জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের প্রক্রিয়াটি এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ ও স্বচ্ছ। অনলাইনে আবেদন করার সুবিধা থাকায় এখন আর অহেতুক হয়রানির শিকার হতে হয় না। শুধু প্রয়োজন একটু সতর্কতা এবং সঠিক কাগজপত্র।

তাই, দুশ্চিন্তা না করে উপরে উল্লিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করুন। আপনার মূল্যবান ডকুমেন্টটি নির্ভুল করে নিন এবং নিশ্চিন্তে থাকুন। যদি এই প্রক্রিয়া নিয়ে আপনার আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আমরা সাহায্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত।

Leave a Comment

Scroll to Top